- 16 August, 2022
- 0 Comment(s)
- 1278 view(s)
- লিখেছেন : তামান্না
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যবর্তী সময়ে আবির্ভাব হয়েছিল বাংলা গল্পের মপাসাঁ প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং যাঁর সম্পর্কে বলেছিলেন— “ছোটগল্প লেখায় পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে তুমি যেন সব্যসাচী অর্জুন, তোমার গাণ্ডীব হইতে তীরগুলি ছোটে যেন সূর্যরশ্মিরমত।” (তথ্যসূত্র:আনন্দবাজার অনলাইন,২৫জুলাই, ২০২০) প্রভাতকুমারের 'রসময়ীর রসিকতা' গল্পটি আপাত দৃষ্টিতে হাস্যরসের মনে হয়, কিন্তু হাস্যরসের মোড়কে সমাজের কুরুচিপূর্ণ দিকটি এই গল্পে তুলে ধরেছিলেন লেখক। ক্ষেত্রমোহন ও রসময়ীর আঠারো বছরের দাম্পত্যতার পরেও মাঝেমাঝে ক্ষেত্রমোহনের মন চঞ্চল হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিয়ের জন্য। রসময়ী যেহেতু সন্তান জন্ম দিতে পারেননি তাই সমস্ত দায় তার উপর বর্তায়! পিতৃতান্ত্রিক সমাজের চরমতম দিকটি প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় হাস্যরসের মাধ্যমে আলোচ্য গল্পে তুলে ধরেছেন। হাস্যরসের পাশাপাশি বিদ্রুপাত্মকভাবে সমাজের বৈষম্যর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন লেখক।
নিঃসন্তান পুরুষের দ্বিতীয় বিয়ে বৈধতা পেয়েছে, আবার রসময়ীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেত্রমোহনের বিয়ে দেবার জন্য আত্মীয়-পরিজন তৎপর হয়ে উঠেছেন। তবে প্রভাতকুমারের অনেক উপন্যাস-গল্পে পতিব্রতা নারীর দেখা পাওয়া যায়। 'নবীনসন্ন্যাসী' (গোপীবাবুর স্ত্রী), 'রত্নদ্বীপ’ (রাখালের স্ত্রী), 'সতীরপতি' (সুরবালা) প্রভৃতি উপন্যাসে এবং 'নূতনবউ'তে নির্মলা, ‘বি. এ. পাশ কয়েদী’তে মোক্ষদা, 'ভুলভাঙ্গা’তে হরিপ্রিয়া পতিপরায়ণা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছেন।
বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাশিল্পী হিসেবে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পরিচিত। তাঁর সৃষ্ট নারী চরিত্ররা- মায়াবী, আত্মত্যাগী, সতী, অবলা, নিপীড়িতা, লাঞ্ছিতা, স্নেহময়ী। তাঁর উপন্যাসের প্রায় সকল নারী চরিত্র জনপ্রিয় হয়েছে। তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে তিনি বিধবা, বৈষ্ণবী, সতী, পতিতা, অরক্ষণীয়ার কথা তুলে ধরেছেন।
‘পল্লীসমাজ’ উপন্যাসে রমা জমিদারি দেখাশোনা করেন। রমেশকে সে সমাজের সামনে সমর্থন করেন না, কিন্তু গোপনে ভালবাসেন। রমা সরবে ঘোষণা করতে পারেন না সে রমেশকে ভালবাসেন। সমাজ কখনও একজন বিধবার- প্রেম, ভালোবাসা, বিয়ে মেনে নেবে না। তাই বাধ্য হয়ে রমা সামাজিক চাপে পড়ে তাঁর নিজের ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেন না। এই উপন্যাসে সন্তানস্নেহপরায়ণ,আদর্শপরায়ণ নারী,মমতাময়ী মা বিশ্বেশ্বরীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়। শরৎচন্দ্র তাঁকে পিতৃতন্ত্রের ছকে আঁকা একজন ‘আদর্শবঙ্গনারী’ হিসাবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
‘বড়দিদি’ উপন্যাসের মাধবী আবার মায়াময়ী। তিনি অগোচরে থাকতে ভালবাসেন। তিনি সহনশীল। ‘গৃহদাহ’র অচলা চরিত্রের মাঝে রয়েছে ভালমন্দের মিশেল। উপন্যাস জুড়ে বৈধ-অবৈধের দোলাচলতা রয়েছে। ঔপন্যাসিক দেখিয়েছেন অচলার দেহ অশুচি হয়ে গেছে, তবুও সে পতিব্রতা। যেহেতু পতিপরমেশ্বর তাই অচলা অন্য পুরুষের সঙ্গে প্রেম করে জঘন্য অন্যায় করেছেন, পাপ করেছেন! সেইজন্য অপরাধী অচলা শাস্তি পেয়েছিলেন। তাঁকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হয়।
‘দেবদাস’ উপন্যাসে দেবদাস নেশা করে নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। এই মদ্যপানের জন্য লেখক কিন্তু দেবদাস, দেবদাসের আত্মীয়স্বজনকে দোষী করেননি। দেবদাসের বিপথে যাবার জন্য দোষী হিসাবে দেখা হয়- পার্বতী ও চন্দ্রমুখীকে। আবার পার্বতীর করুণ চিত্র এই উপন্যাসে দেখা যায়। শরৎ সাহিত্যে অসহায় করুণ নারীদের সঙ্গে আমাদের একাধিক বার সাক্ষাৎ হয়েছে।
‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের তিনজন প্রধান নারীচরিত্র রাজলক্ষ্মী, কমললতা, অন্নদাদিদি সমাজকে মানবেন না মনে করলেও সমাজের বন্ধনকে ত্যাগ করতে পারেননি। অন্নদাদিদির সতীত্ব দেখে সত্যিই অবাক লাগে! স্বামীর ভক্তিতে গদগদ অন্নদা স্বামীর সকল অন্যায় কাজকে সমর্থন করে গেছেন। খুনি ও ছদ্মবেশী স্বামীর জন্যই তিনি কুল ত্যাগ করেন। এমনকি তিনি কুল-কলঙ্ক বয়ে নিয়ে চলেন। শরৎ-সাহিত্যে নারী, এই বই থেকে অন্নদাদিদি সম্পর্কে জানা যায়- “শরৎ- সাহিত্যে একশ্রেণীর নারী আছে, তাহারা সমাজের প্রত্যেকটি নিয়ম মানিয়া লইয়া সমাজের পায়ে আত্মোৎসর্গ করিয়াছে, সমাজের প্রতি কোন কর্তব্য সম্পাদনেই ইহাদিগকে বিন্দুমাত্র পরাঙ্মুখ আমরা দেখি না, কিন্তু তবুও সমাজের কোলে ইহাদের স্থান হয় নাই, রিক্ত হস্তেই ইহারা সকলে সমাজের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়াছে। আপন ভাগ্যকে ইহারা কোনদিন দোষ দেয় নাই। ব্যথা বেদনাই সমাজের নিকট আপনাদের একমাত্র প্রাপ্য বলিয়া ইহারা জানিয়া লইয়াছিল। শরৎ-সাহিত্যে এই শ্রেণীর নারীর কথা মনে হইলে প্রথমেই আমাদের মনে পড়ে অন্নদাদিদিকে।” (তথ্যসূত্রঃ ক্ষীরোদ কুমার দত্ত (সম্পা), ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ, শরৎ-সাহিত্যে নারী, কল্লোল প্রকাশনী,কলকাতা, পৃ-১৭)
‘বিরাজবৌ’ উপন্যাসে বিরাজ তাঁর স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছিলেন কেবল যাতনা, গঞ্জনা। বিরাজ গৃহত্যাগ করতেও বাধ্য হয়েছিলেন, তবুও তিনি সতীত্বের অবমাননা করেন নি। আবার উপন্যাসে দেখছি তাঁকে তাঁর জীবনপণ করে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে! ‘দেনা-পাওনা’ উপন্যাসেও ষোড়শীকে তাঁর সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়।
‘অরক্ষণীয়া’ উপন্যাসে সমাজ পরিত্যক্তা এগারো বছরের করুণ বালিকা জ্ঞানদার দুঃখময় জীবনের চিত্র শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন। ‘শেষপ্রশ্ন’ উপন্যাসে কমলের চারিত্রিক দ্বন্দ্বের থেকে মতাদর্শের দ্বন্দ্ব প্রবল ভাবে দেখা দিয়েছে। কমল একাধিক পুরুষকে তাঁর জীবনসঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করেছেন। এই উপন্যাসে বিবাহিত নারীর নৈতিক সংকট দেখানো হয়েছে।
‘নিষ্কৃতি’ উপন্যাসে তিনজন নারীচরিত্র সিদ্ধেশ্বরী, নয়নতারা ও শৈল। শৈল সবার ছোট ছিলেন, কিন্তু সংসারের সমস্ত দায়িত্ব ছিল তাঁর উপর। বড়জা সিদ্ধেশ্বরী তাঁকে নিজের মেয়ের মত ভালবাসতেন। কিন্তু নয়নতারার চক্রান্তে সেই সম্পর্কে ফাটল ধরে। স্বামী-সন্তানসহ শৈল বাড়ি ছেড়ে চলে যান। নারীদের সম্পর্কের জটিলতা এই উপন্যাসে প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর বেশিরভাগ উপন্যাসের নারীদের সৃষ্টি করেছিলেন অসহায়ভাবে। সতীত্বের জয়জয়কার করেছেন বেশিরভাগ উপন্যাসে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ও গল্পের প্রতিবাদী নারীদের পাশে শরৎচন্দ্রের নারীরা অনেকাংশে ফিকে হয়ে গেছে! তবে সেই সময়ের পাঠকদের কথা মাথায় রেখে হয়তো শরৎচন্দ্র এই ধরনের ‘অসহায়’,‘অবলা’ চরিত্রগুলি সৃষ্টি করেছিলেন। “শরৎ- সাহিত্যের সকল নারীহৃদয়েই এই গোপন অশ্রুর ফল্গুধারা আমরা দেখি। এই অশ্রুধারাসিক্ত জীবনই তাঁহাকে পাঠকের নিকট প্রিয় ও আকর্ষণীয় করিয়া তুলিয়াছে, আর সকল ক্ষেত্রেই সমাজের সঙ্গে নারীহৃদয়ের দ্বন্দ্ব ইহার মূলে।” (ক্ষীরোদ কুমার দত্ত (সম্পা), ১৩৬৭ বঙ্গাব্দ, শরৎ-সাহিত্যে নারী,কল্লোল প্রকাশনী,কলকাতা, পৃ-১৩)
0 Comments
Post Comment